ফুটবলের ইতিহাস গড়তে চেয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। রুপকথার গল্পও প্রায় লিখে ফেলেছিল। কিন্তু কী এক যাদুমন্ত্রবলে শেষ দৃশ্যপটটি হঠাত্ বদলে গেল। সোনার কাপের কাছে গিয়েও তা ধরতে পারল না ক্রোয়েশিয়া। সোনালী কাপটি ছিনিয়ে নিল ৯৮ বিশ্বকাপ বিজয়ী সেই ফ্রান্স। ফরাসি সৌরভ ছড়ালো মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। যে হাতে ৯৮ এর বিশ্বকাপ ঘরে তুলেছিলেন দিদয়ের দেশম অধিনায়ক হিসেবে, সেই একই হাতে আবারো কাপ নিলেন তিনি। তবে এবার কোচ হয়ে। ট্রফি জয়ের দীর্ঘদিনের ক্ষুধা মিটিয়েছেন তিনি। তছনছ করে দিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্ন। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালের বড় বড় সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এতো দূর এসেও শেষ রক্ষা হলো না ক্রোয়েটদের।
যদিও পুরো বিশ্বকাপজুড়ে অসাধারণ খেলেছে ক্রোয়েশিয়া। তিনটি ম্যাচ ১২০ মিনিট পর্যন্ত খেলতে হয়েছিল তাদের। ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে দুর্দান্ত শুরু করলেও মনে হচ্ছিল কিছুটা ক্লান্ত। যদিও ক্রোয়েটদের কোচ জ্লাতকো দালিচ বলেছিলেন, ক্লান্তি খেলোয়াড়দের কিছু করতে পারবে না। আর ফ্রান্সের কোচ বলেছিলেন এখন বিশ্বকাপ শুরু। দিদিয়ের আসলে অনেক ভালো কোচ। তার অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। ফুটবলের মারপ্যাঁচটা ভালো বুঝেন। কখন কি করতে হবে সেটা সময়ের সঙ্গে করে নিতে পারেন। প্রতিটা খেলায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে রিওতে আলাদা কোনো সাজগোজ ছিল না। কিন্তু লুঝনিকির মাঠে আলাদা সাজসজ্জা ছিল। ঘরে মেহমান আসবে বলে যেভাবে সাজানো হয় সেভাবে সাজানো হয়েছিল স্টেডিয়াম। খেলা শুরু হওয়ার আগে ঝলমলে একটা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। রেফারি খেলোয়াড়দের নিয়ে মাঠে নামার আগে সুসজ্জিত একটা বাক্স হতে সোনার ট্রফি উন্মোচন করেন। সেই ট্রফির দিকে তাকিয়ে ছিলেন লুকা মদরিচ। মনে হয়েছিল ট্রফিটা ছোঁয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। তার পাশেই লাইনআপে ছিলেন ফ্রান্সের স্পিডস্টার গ্রিজম্যান। কি দেখে যেন মাথা নিচু করে হাসছিলেন তিনি।
ফ্রান্স এবং ক্রোয়েশিয়া থেকে লাখো সমর্থক এসেছিলেন মস্কোতে। টিকিট না থাকলেও বিশ্বকাপের শহরে থাকবেন। এমবাপে, পগবা, কান্তে, হার্নান্দেরজ, মাতুইদি, উমিদি, লরিসদের ফুটবলের কাছে ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ফ্রান্স আসলে দেখিয়ে দিয়েছে গোডাউনে স্টক রেখেও ফুটবল খেলা যায়। তাই তো কাউন্টার এ্যাটাকে তারা ক্রোয়েশিয়ার উপর কামান চালিয়েছে। আর্জেন্টিনার রেফারি নেসর পিতানা যখন শেষ বাঁশিটা বাজালেন জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা গেল জার্সি গায়ে ক্রোয়েশিয়ার নারী প্রেসিডেন্টকে জড়িয়ে ধরে সান্তুনা দিচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ফিফার প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো। মাঠে তখন উল্লাস। ফরাসি ফুটবলের সৌরভে পুরো স্টেডিয়াম আক্রান্ত। সমর্থকরা হাসছে, নাচছে, আনন্দ করছে। অন্যদিকে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা গেছে ক্রোয়েটদের। ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলারদের চোখে পানি। বাদ্যের তালে তালে ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা নাচলেও একবুক হতাশায় মাঠের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন লুকা মদরিচরা।
আসলে ভাগ্য খারাপ না হলে কি এমনটা হয় ? নইলে ১৮ মিনিটেই আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে যাবে ক্রোয়েশিয়া? ফ্রান্সের বিপদজনক ফুটবলার যাকে নিয়ে ভয় সেই গ্রিজম্যান সেট পিস থেকে বল মারলেন। ক্রোয়েশিয়ার মারিও মানজুকির মাথা ছুঁয়ে বলটি ঢুকে গেল নিজেদেরই জালে। ফলাফল ১-০। এই মানজুকিই সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর পেছনের কারিগর। ম্যাচ জেতা গোলটা করেছিলেন তিনি। আর তার মাথায় লেগেই কিনা নিজেরা গোল হজম করবে, স্বপ্নেও ভাবেনি ক্রোয়েটরা। ৩১ মিনিটেই ফ্রান্সকে পাল্টা জবাব দিল ক্রোয়েশিয়া। ভিদারের নামিয়ে দেয়া বলটা চোখ ধাঁধানো শটে দুর্দান্ত গোল করলেন ইভান পেরিসিক, ফলাফল ১-১। এই ফুটবলারও সেদিন ইংল্যান্ডের জালে বল ফেলেছিলেন। দুর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়ছিল না ক্রোয়েশিয়ার। ইভান পেরিসিকের হাতে বল স্পর্শ করেছে সেটা ভিডিও অ্যাসিসটেন্ট রেফারি জানিয়ে দিল আর্জেন্টাইন রেফারি নেসর পিতানাকে। পেনাল্টি থেকে আবারও গোল করে গ্রিজম্যান ফ্রান্সকে এগিয়ে নিল ২-১ এ।
ক্রোয়েশিয়া পিছিয়ে থাকলেও তাদের সমর্থকরা যেন পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। খেলার ৫২ মিনিটে আচমকা তিনজন সমর্থক হঠাত্ মাঠে ঢুকে গেলেন। নিরাপত্তাকর্মী ছুটল তাদের পেছনে। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা ঐ তিনজনকে মাঠ থেকে সরিয়ে নেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার খেলা শুরু হয়।
আবার ফ্রান্সের রাজত্ব। আগেই জানা ছিল এমনটা হবে। কারণ আগের খেলাগুলোতে দ্বিতীয়ার্ধে গিয়ে ফ্রান্স ভিন্ন স্টাইলে খেলে। ততক্ষণে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগ ভেঙ্গে চুরমার। ফ্রান্স রাজত্ব চালালো। পগবা স্কোর লাইন বাড়িয়ে দিলেন ফলাফল ৩-১। পরবর্তীতে ৬৫ মিনিটে এমবাপের গোলে ফ্রান্সের স্কোর ৪-১। ক্রোয়েশিয়ার বুকে একটার পর একটা পেরেক ঠুকে গেলেন ফরাসি ফুটবলাররা। পরে ফ্রান্স যে গোলটা হজম করল তা ওদের নিজেদের ভুলে। এমন ভুল পুরো বিশ্বকাপেও কেউ দেখেনি। বলটি ব্যাকপাস করা হয়েছিল। পরে ফ্রান্সের গোলকিপার বল পা দিয়ে নিজেদের খেলোয়াড়কে দিতে চাচ্ছিলেন, তখন ক্রোয়েশিয়ান মানজুকি দৌঁড়ে এসে গোলকিপারের কাছ থেকে বল নিয়ে ফ্রান্সের জালে ঢুকিয়ে দেন, ফলাফল দাঁড়ায় ২-৪। এখানেই থেমে গেল ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্ন।
Leave a Reply